নেতা (3/3)

(আগের পৃষ্ঠা)

এভাবে প্রথম দিন কেটে গেল এবং একই রকম সাফল্য অর্জন করতে করতে আরও অনেক দিন কাটল। খুব তাত্পর্যপূর্ণ কিছুই ঘটেনি, কেবল তুচ্ছ ঘটনা: “তার মুখ-থুবড়ে একবার খাদে পরে যায়, তারপর একটি গিরিসংকটে; তারপর ব্ল্যাকবেরির ঝোপে ঘষা লাগে; কাঁটায় পা দেন; অনেকের হাত পা ভাঙ্গে; অনেকে মাথায় আঘাত লাগে। কিন্তু এই সমস্ত যন্ত্রণা তারা সহ্য করে নিয়েছিল। কয়েকজন বৃদ্ধকে রাস্তায় মড়ার জন্য ফেলে যেতে হয়েছিল। „তাদের বাড়িতে রেখে আসলেও তারা মারা যেতো, রাস্তায় না হলেও!” মুখপাত্র বলেছেন, অন্যদের পথ কলতে উৎসাহিত করার জন্য। এক থেকে দুই বছর বয়সী কয়েকটি ছোট বাচ্চাও মারা গেল। পিতা-মাতা উদ্বেগহীনভাবে নিজেদের ব্যথা দমন করেছিলেন কারণ এটিই ঈশ্বরের ইচ্ছা। “আর বাচ্চাদের বয়স যত কম তাদের দুঃখ তত কম। যখন তাদের বয়স কম থাকে তাদের দুঃখও কম হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে বিবাহের বয়সে পৌঁছে গেলে সন্তানের যেন মৃত্যু না হয়।সন্তানদের যদি মরতেই হয় তবে কম বয়সে মরা ভালো। তাহলে দুঃখ এত বেশি হয় না!” মুখপাত্ররা তাদের আবার সান্ত্বনা দিয়ে বলেন। কেউ কেউ মাথায় কাপড় জড়িয়ে রাখেন এবং মাথায় ঠান্ডা জিনিস চাপান। অন্যরা হাতে পট্টি বেঁধে চলেন। সবাই ক্লান্ত ও আহত ছিলেন। তাদের জামা কাপড় জরাজীর্ণ, কিন্তু তারা খুশি হয়ে এগিয়ে চলতে থাকে। এগুলি সহ্য করা আরও সহজ হত যদি ক্ষুধার্ত না হতেন। তা সত্তেও তাদের পথ চলা চালিয়ে যেতে হবে।

একদিন, আরও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে।

নেতা সবার সামনে হেঁটে যাচ্ছিলেন, দলের সাহসী লোকেরা তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। (তাদের মধ্যে দু’জন নিখোঁজ ছিল কিন্তু কেউ জানত না তারা কোথায় ছিল। সবার ধারণা ছিল তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং পালিয়ে গেছে। একসময় মুখপাত্র তাদের লজ্জাজনক বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন। মাত্র কয়েকজন বিশ্বাস করেছিলেন যে পথে ওই দু’জন মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু তারা অন্যদের উদ্বিগ্ন করতে চাননি তাই তারা নিজদের মতামত কাউকে জানানি।) দলের বাকিরা তাঁর পিছনে সারি বোধ্য করে ছিল। হঠাৎ দেখা গেল এক বিশাল বড় এবং গভীর, পাথুরে খাদ। ঢাল এত খাড়া ছিল যে কারুর এক পা সামনে এগোনোর সাহস হচ্ছিল না। এমনকি সব থেকে সাহসী ব্যক্তিরাও থামে গিয়ে নেতার দিকে তাকালেন। মাথা নীচু করে চিন্তায় মগ্ন হয়ে তিনি সাহস করে সামনে এগিয়ে গেলেন, তার বেতটি সামনে ঠুকতে ঠুকতে প্রথমে ডানদিকে, তারপর বাম দিকে, তার সভাব বৈশিষ্ট অনুসারে। অনেকে বলেছিলেন যে তিনি যখন এই রকম করেন তখন থাকে দেখে খুব অভিজাত মনে হয়। তিনি কারুর দিকে তাকান না কিছু বলেন না। তিনি যখন কিনারের দিকে এগিয়ে যাচ্চিলেন তখনও তাঁর মুখের অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন বা ভয়ের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুব সাহসী লোকেদের ও মুখে রক্ত শূন্য হয় গেছিল, কিন্তু নেতা কে সাবধান করার সহস কারুর ছিল না। কিনারে পৌঁছাতে আর মাত্র দুটি ধাপ বাকি ছিল। আতঙ্কে এবং চোখ খোলা রেখে তারা সকলে ভয় কাঁপতে থাকে। সাহসী লোকেরা শৃংখলা লঙ্ঘন করে প্রায়ে নেতা কে আঁকাতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই নেতা দুই ধাপ এগিয়ে গিয়ে খাদে ঝাঁপিয়ে পরেন। উদ্বেগ, হাহাকার, চিৎকার করে উঠে সবাই; ভয়ের জিত হয়। অনেকে পালাতে শুরু করেন।

– দাঁড়াও ভাইয়েরা! তাড়া কিসের? আপনারা কি এইভাবে কথা রাখেন? আমাদের অবশ্যই এই জ্ঞানী ব্যক্তিটি কে অনুসরণ করতে হবে কারণ তিনি জানেন তিনি কি করছেন। তিনি নিজেকে শেষ করে ফেলার মত উন্মাদ নন। আগে এগিয়ে যাওয়া যাক তার পিছনে পিছনে! এটিই সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত সর্বশেষ বিপত্তি, শেষ বাধা। কে জানে? সম্ভবত এই উপত্যকার অপর পারে আমরা একটি দুর্দান্ত, উর্বর জমি পাব যা ঈশ্বর আমাদের জন্য ঠিক করে রেখেছেন। এগিয়ে যাওয়া যাক! ত্যাগ ছাড়া আমরা কিছুই পাব না! – এগুলি ছিল মুখপাত্রের পরামর্শের বাণী এবং তিনিও উপত্যকার দিকে দুই ধাপ এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয় যান। সাহসীরা তাকে অনুসরণ করেন এবং তারপরে সবাই ঝাঁপিয়ে পরে।

সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করতে শুরু করে নিচে গড়িয়ে পড়তে পড়তে। যে কেউ শপথ করে বলতে পারে ওখান থেকে কারুর বেঁচে ফিরে আসর সম্ভাবনা ছিলনা। কিন্তু নেতা অস্বাভাবিকভাবে ভাগ্যবান ছিলেন। তিনি পড়ে যেতে যেতে একটি ঝোপ ধরে ঝুলে পরেন তাই তার বেশি আঘাত লাগেনা। তিনি নিজেই কষ্ট করে ধরে ধরে উঠে আসতে পারেন। খাদের নিচে যখন কান্নাকাটি, বিলাপ, চিৎকার-চেঁচামেচি চলছিল তিনি নিশব্দে ওপরে বসে ছিলেন। আহত এবং ক্রুদ্ধ কয়েকজন তাকে অভিশাপ দিতে শুরু করলেও তিনি কোনো ভ্রূক্ষেপ করেন না। ভাগ্যক্রমে যারা পড়ে যাওয়ার সময় ঝোপ বা গাছ ধরে রাখতে পেরেছিলেন তারা ওপরে উঠতে শুরু করে খাদ থেকে বেরোনোর জন্য। কারও কারও মাথা ফেটে গিয়েছিল বলে মুখ বেয়ে রক্ত ঝরছিল। নেতা ছাড়া বাকি সবার অঘাত লেগেছিল। তারা সকলেই হঠাৎ তাকে দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে এবং যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন কিন্তু নেতা মাথা তোলেন না। তিনি নীরব থাকন একজন চিন্তাভাবনা রত সাধুর মত!

কিছু সময় কেটে গেল। যাত্রীর সংখ্যা দিনে দিনে কমতে থাকে। কেউ কেউ দল ছেড়ে আবার ফিরে যায়।

অত বড় দলটির মাত্র কুড়ি জন রয়ে যায়। তাদের ক্লান্ত মুখগুলোতে হতাশা, সন্দেহ, অবসন্নতা এবং ক্ষুধার লক্ষণ ফুটে উঠেছিল কিন্তু কেউ একটা কোথাও বলে না। তারা তাদের নেতার মতোই চুপচাপ হয়ে সামনে হেঁটে যাচ্ছিল। এমনকি উৎসাহী মুখপাত্র মরিয়া হয়ে মাথা নাড়াতে থাকেন। রাস্তা খুবই কঠিন ছিল।

দিন দিন তাদের সংখ্যা কম হতে থাকে শেষ পর্যন্ত মাত্র দশজন বাকি থেকে যায়। হতাশ মুখগুলি নিয়ে, তারা কেবল কথো না বলে হাহাকার এবং অভিযোগ করতে থাকে।

তাদের দেখে পঙ্গু মনে হয়। কেউ কেউ ক্রাচে ভোর দিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে কিছু জন ঘাড়ের সাথে বাঁধা হাতের বন্ধনের ওপর ভোর দিয়ে হাঁটছিল। এবং তাদের হাতে আরো অনেক ব্যান্ডেজ ছিল। এমনকি যদি তারা নতুন ত্যাগ স্বীকার করতে চাইত, তারা করতে পারত না কারণ তাদের দেহে কোনও নতুন ক্ষতের জন্য প্রায় কোনও খালি জায়গায় ছিল না।

এমনকি তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সাহসীরা ও ইতিমধ্যে বিশ্বাস এবং আশা হারিয়ে ফেলেছিল তবে তারা লড়াই করে যাচ্ছিল; মানে তারা কোনো রকমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিল অভিযোগ করতে করতে, অনেক ব্যথা সহ্য করে। ফিরে যেতে না পারলে আর কি বা করার ছিল? এত ত্যাগ করেও এখন কি যাত্রা ছেড়ে চলে যাওয়া যায়?

গোধূলি হয়। ক্রাচে ভর করে খোড়াতে খোড়াতে তারা হঠাৎ দেখতে পেল যে নেতা আর তাদের সামনে নেই। আর একটি পদক্ষেপ নিতে তারা দেখল তারা আবার কোনো খাদে পড়ে যাচ্ছে।

– ওহ, আমার পা! ওহ, আমার হাত! – কান্নার রোল ওঠে। এমনকি একটি দুর্বল কণ্ঠ যোগ্য নেতাকে অভিশাপ দেয় কিন্তু তারপরেই চুপ হয় যায়।

যখন সূর্য উঠল, সেখানে নেতা বসে ছিলেন, যেদিন তাকে বেছে নেওয়া হয়ছিল সেদিনের মত। তাঁর চেহারায় কিছু পরিবর্তন হয়নি।

মুখপাত্র খাদ থেকে উপরে উঠে আসে, তার পিছনে আরও দুজন। আহত এবং রক্তাক্ত, আর কত জন বেঁচে আছে আছে দেখার জন্য তারা পেছন ফেরে, কিন্তু শুধু তারাই বেঁচে ছিল। তাদের হৃদয় হতাশা এবং ভয় ভরে ওঠে। অঞ্চলটি অজানা, পাহাড়ি, পাথুরে – কোথাও কোনও পথ ছিল না। দুদিন আগ তারা একটি রাস্তা দেখতে পেরেছিল কিন্ত তারা সেটি ছেড়ে আসে। নেতা তাদের এই পথে নিয়ে আসে।

তারা এই দুর্দান্ত ভ্রমণে মারা যাওয়া অনেক বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে ভেবেছিল। তাদের পঙ্গু অঙ্গগুলির ব্যথার চেয়ে শক্তিশালী এক দুঃখ তাদেরকে পরাভূত করে। তারা নিজের চোখে নিজের ধ্বংস দেখেছে।

মুখপাত্র নেতার কাছে গেলেন এবং ব্যথা, হতাশা এবং ভীত কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করলেন।

– আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

নেতা নিরব ছিলেন।

– আপনি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এবং কোথায় নিয়ে এসেছেন? আমরা নিজেদের এবং আমাদের পরিবারগুলিকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম এবং আমরা আপনাকে অনুসরণ করেছি আমাদের বাড়ি এবং পূর্বপুরুষদের কবর পিছনে ফেলে রেখে এই আশায় যে আমরা সেই অনুর্বর ভূমিতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারব। কিন্তু আপনি আমাদের আরও খারাপভাবে ধ্বংস করেছেন। আপনার পিছনে দু’শ পরিবার ছিল এবং এখন দেখুন কতজন আছে!

– আপনার মানে সবাই এখানে নেই? – নেতা মাথা না তুলে নিচু গলায় বলেন।

– আপনি কিভাবে এই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন? তাকিয়ে দেখুন! দুর্ভাগ্যজনক এই যাত্রায় আমাদের মধ্যে কত জন রয়ে গেছে তা গণনা করুন! দেখুন আমাদের কি অবস্থা! এভাবে পঙ্গু হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল ছিল।

– আমি আপনাদের দেখতে পাব না!

– কেন?

– আমি অন্ধ।

সম্পূর্ণ নিরবতা।

– ভ্রমণের সময় আপনি কি আপনার দৃষ্টি হারিয়েছেন?

– আমি জন্ম অন্ধ!

তিনজন হতাশায় মাথা নিচু করে।

শরৎ কালের বাতাস পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটি শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে আসে। কুয়াশা পাহাড় ঢেকে ফেলে, ঠাণ্ডা, ভিজে হওয়ায় একটি কাক উড়তে থাকে। একটি অশুভ শঙ্কেতে চারিদিক ভরে ওঠে। সূর্য মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, যা আরও দূরে এবং দ্রুত বয়ে যাচ্ছিল।

তিনজন একে অপরের দিকে ভীতির সাথে তাকায়।

– আমরা এখন কোথায় যাব? – একজন হতাশ স্বরে বলেন।

– আমরা জানি না!

 

বেলগ্রেডে, 1901।
রাদ্বয়ে ডোমানোভিচ” প্রকল্পটির জন্য অনুবাদ করেছেন মৈত্রেয়ী মন্ডল, 2020।

Ознаке:, , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , ,

About Домановић

https://domanovic.wordpress.com/about/

Оставите одговор

Попуните детаље испод или притисните на иконицу да бисте се пријавили:

WordPress.com лого

Коментаришет користећи свој WordPress.com налог. Одјавите се /  Промени )

Слика на Твитеру

Коментаришет користећи свој Twitter налог. Одјавите се /  Промени )

Фејсбукова фотографија

Коментаришет користећи свој Facebook налог. Одјавите се /  Промени )

Повезивање са %s

%d bloggers like this: