নেতা (2/3)
পরদিন যে দীর্ঘ যাত্রা করার সাহস যাদের ছিল তারা সবাই একত্রিত হয়। দুই শতাধিক পরিবার নিযুক্ত স্থানে আসেন। পুরাতন বাস ভূমি দেখাশোনা করার জন্য কেবল কয়েকজন রয়ে যায়।
এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের দুর্ভাগ্যের কারণে বাধ্য হয়ে নিজেদের জন্মস্থান, যেখানে তাদের পূর্বপুরুষদের কবর দেওয়া হয়ছে সেই জায়েগা ছেড়ে যেতে দেখা সত্যই দুঃখের বিষয় ছিল। তাদের মুখগুলি ক্লান্ত, জরাজীর্ণ এবং রোদে পোড়া ছিল। দীর্ঘ বহু বছরের কঠোর পরিশ্রমের প্রভাব তাদের চেহারায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, তাদের চেহারায় শুধুই ক্লান্তি ও হতাশা দেখা যাচ্ছিল। তবে এই মুহুর্তে আশার প্রথম ঝলক দেখা গিয়েছিল – তবে অবশ্যই তার সাথে মিশে ছিল বাড়ি ছাড়ার বিষন্নতা। অনেক বৃদ্ধের চোখ দিয়ে জল ঝড়ছিল, তাঁরা নিরাশা হয় দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন এবং আরো দুর্ভোগের আশংকায় মাথা নাড়ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল আর কিছু দিন থেকে যাওয়ার যাতে তিনিও এই পাথরের মধ্যে দেহ ত্যাগ করতে পারেন আরও ভালো বাস ভূমি সন্ধান করার পরিবর্তে। অনেক মহিলা উচ্চস্বরে শোক প্রকাশ করে নিজেদের পরিজনদের বিদায় জানালেন যাদের কবর তারা পিছনে ফেলে যাচ্ছে।
পরুষের দেখাতে চাইছিল তারা খুব সাহসী তাই তারা চিৎকার করছিল, – আচ্ছা, তাদলে কি আপনারা এই খারাপ জায়াগায় ঝুপড়িতে বাস করা অনাহারে দিন কাটাতে চান? – প্রকৃতপক্ষে যদি সম্ভব হত তবে তারা নিজেদের সাথ ইচ্ছা ছিল পুরো অঞ্চলটা নিজেদের সাথে নিয়ে যায়।
সাধারণত মানুষের ভিড়ে যেমন আওয়াজ হয় সেই রকম আয়জায় ও চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। নারী পুরুষ সবাই অস্থির ছিল। বাচ্চারা তাদের মায়ের কোলে চেচামেচি করছিল। এমনকি পশুরাও কিছুটা অস্বস্তিতে ছিল। বেশি গরু ছিলনা, এদিক ওদিকে একটা দুটো হাড় জীর্ণ বাছুরও ছিল, এবং ছিল একটা বড় মাথা মোটা পা কিন্তু রোগা শরীর ঘোড়া, পিঠে তার পুরনো কম্বল, ব্যাগ আর জিনের উপর দুটো ভর্তি বস্তা, ওজনের চাপে বেচারা জন্তুটি দুলছিল। তুবও সেটা কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং মাঝে মাঝে ডাক ছারে। অন্যরা গাধার পিঠে জিনিস রাখছিল; এবং বাছারা কুকুরের গলার দড়ি ধরে টানছিল। কথা বলা, চিৎকার, চেঁচামেচি, গালাগালি, কান্না, কুকুরের ডাক, ঘোড়ার ডাক – সব কিছুই একটু বেশি মাত্রায় হচ্ছিল। এমন কি একটা গাধাও কয়েক বার ডেকে ওঠে। কিন্তু নেতা একটা কোথাও বলে না, যেন পুরো ব্যাপারটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। একজন সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি!
তিনি কেবল মাথা নিচু করে নিরবে বসে থাকেন। কখনো কখনো থুথু ফেলেন, আর কিছু না। কিন্তু তাঁর এই অদ্ভূত আচরণের কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছিল যে তাঁর আজ্ঞা অনুসারে সবাই আগুনে বা জলে ঝাঁপ দিতেও রাজি ছিল, যেমন তারা বলেছিল।
– এমন কাউকে খুঁজে পেয়ে আমাদের খুশি হওয়া উচিত। ঈশ্বর জানেন কি হত যদি আমরা তাঁকে সাথে না নিতাম! আমরা মারা পরতাম। আমি আপনাকে বলছ এনি সত্যিকারার বুদ্ধিমান! তিনি চুপ করে আছেন। তিনি এখনও পর্যন্ত একটি কোথাও বলেননি! – একজন শ্রদ্ধা ও গর্বের সাথে জেতার দিকে তাকিয়ে বলে।
– তিনি কি বলবেন? যারা বেশি কথা বলেন তারা খুব বেশি চিন্তা করেন না। উনি নিশ্চই খুব বুদ্ধিমান! তিনি কেবল চিন্তা-ভাবনা করেন এবং কিছুই বলেন না – আরো একজন বলেন, এবং তিনিও বিস্ময়ের সাথে নেতার দিকে তাকান।
– এত লোকের নেতৃত্ব করা সহজ নয়! তাঁকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে কারণ তিনি অনেক বড় দায়িত্ব নিয়েছেন, – প্রথম ব্যক্তি অবার বলেন।
যাত্রা শুরু করার সময় হয়। তারা সবই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, দেখার জন্য আর কেউ মত পাল্টে তাদের সাথে যেতে রাজি আছে কিনা, আর কেউ আসে না তাই আর তাদের সেখানে অপেক্ষা করা চলে না।
– আমাদের কি যাওয়া উচিত নয়? – তারা নেতা কে জিজ্ঞাসা করে।
নেতা কোনো কথা না বলে ওঠে দাঁড়ায়।
বিপদ বা জরুরী পরিস্থিতিতে নেতার পাশে থাকার জন্য সবচেয়ে সাহসী পুরুষরা নেতার চারপাশে দলবদ্ধ হয়।
নেতা, চেহারায় বিরক্তি নিয়ে, মাথা নিচু করে কয়েক ধাপ হাঁটেন সম্মানজনকভাবে নিজের সামনে নিজের বেত দোলাতে দোলাতে। সমাবেশটি তার পিছনে পিছনে চলতে থাকে এবং একাধিকবার চেঁচিয়ে ওঠে, “আমাদের নেতা দীর্ঘ জীবী হোক!” তিনি আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গ্রামের হল ঘরের সামনের বেড়াতে ধাক্কা খান। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই তিনি থামলেন; সুতরাং দলটিও থেকে যায়। তারপর নেতা খানিকটা পিছনে গিয়ে বেড়ার ওপর নিজের লাঠি দিয়ে কয়েকবার আঘাত করেন।
– আপনি আমাদের কি করতে আজ্ঞা করেন? – তারা জিজ্ঞাসা করে।
তিনি কিছুই বললেন না।
– আমাদের কি করা উচিৎ? বেড়া ভেঙে ফেলো! আমাদের এটাই করা উচিত! দেখতে পাচ্ছেন না উনি নিজের লাঠি দিয়ে আমাদের সেই রকমই নির্দেশ দিচ্ছেন? – যারা নেতার চারপাশে দাঁড়িয়েছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠে।
– ঐ যে ফটক! ঐ যে ফটক! – বাচ্চারা চিৎকার করে তাদের অল্ট দিকের ফটকের দিকে আঙুল তুলে দেখায়।
– চুপ কর, বাচ্চারা!
– ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন, কি যে হচ্ছে? – কয়েক জন মহিলা চিন্তিত হয় বলেন।
– কেউ কিছু বলবেন না! উনি জানেন আমাদের কি করা উচিত! বেড়া ভেঙে ফেলা হোক!
এক মুহুর্তে বেড়া ভেঙে ফেলা হল যেন সেখানে কখনও কোনো বেড়া ছিলই না।
তারা বেড়া ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়।
বড়জোর তারা একশো ধাপ এগিয়ে ছিল নেতা একটা কাঁটা ঝোপে ধাক্কা খেয়ে থেমে যান। অনেক চেষ্ট করে তিনি ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসেন ও নিজের লাঠি দিয়ে নিজের চারপাশের মাঠি ঠুকতে শুরুর করেন। কেউ এগিয়ে যায় না।
– এবার কি হল? – পিছনে যারা ছিল তারা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করে।
– কাঁটা ঝোপ কেটে ফেলো! – নেতার চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা বলে ওঠে।
– ওই যে রাস্তা, ঝোপের পিছনে! ওই কে দেখা যাচ্ছে! – বাচ্চারা এবং পিছন দিকে অনেক লোক চিৎকার করে ওঠে।
– ওই যে রাস্তা! ওই যে রাস্তা! – নেতার আশেপাশের লোকের ঠাট্টা-বিদ্রূপের স্বরে বলে ওঠে। – আমরা অন্ধ লোকেরে কিভাবে জানবো উনি আমাদের পথ দেখিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সবাই আজ্ঞা দিতে পারে না। নেতা সবচেয়ে ভাল এবং সোজা রাস্তা চেনেন। কাঁটা ঝোপ কেটে ফেলো!
সবাই রাস্তা পরিস্কার করতে ঝাঁপিয়ে পরে।
– আহ, -যার হাতে কাঁটা ফুটেছিল সে চেঁচিয়ে ওঠে তার সাথে যার মুখে ব্ল্যাকবেরি ডালের কাঁটা ফোটে সেও কঁকিয়ে ওঠে।
– ভাইয়েরা, তোমরা কিছু না হারিয়ে কিছু পেতে পারনা। সাফল্য অর্জনের জন্য তোমাদের কষ্ট করতে হবে, – উত্তর দেয় দলের সব থেকে সাহসী ব্যক্তি।
তারা অনেক কষ্টে ঝোপ ভেঙে এগিয়ে চলে।
আরও কিছুদূর ঘোরাফেরা করার পরে, তারা একগুচ্ছ লগির সাথে সাথে ধাক্কা খায়। এগুলোকে ও সরানো হয়। তারপর তারা অবার পথ চলতে থাকে।
প্রথম দিন খুব সামান্য পথ চলা হয় কারণ তাদের অনেকগুলি একই রকম বাধা অতিক্রম করতে হয়। তাদের খাছে খাবার সল্প পরিমাণে ছিল কারণ কিছি লোক সঙ্গে শুধু কিছু শুকনো রুটি আর চিজ এনেছিল, অন্যদের কাছে শুধুই সামান্য রুটি ছিল। কিছুই লোকের কাছে কোনো খাবারই ছিল না। ভাগ্যক্রমে গ্রীষ্মের সময় ছিল তাই তারা এখানে সেখানে একটা দুটো ফলের গাছ পেয়েছিল।
সুতরাং, যদিও প্রথম দিনে তারা খুবই কম দুরুত্ব পিছনে ছেড়ে আসতে পেরেছিল তবুও তারা তারা খুব ক্লান্ত বোধ করেছিল। কোনও বড় বিপদ বা কোনও দুর্ঘটনাও ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবেই এত বড় একটি উদ্যোগের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ঘটনাগুলিকে অবশ্যই সামান্য হিসাবে বিবেচনা করা উচিত: একজন মহিলার চোখে কাঁটা ফুটে যায়, তিনি সেটা এন্টি ভিজে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখানে; একটি বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে লগির সাথে ধাক্কা খায়; একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের পা মচকে যায় ব্ল্যাকবেরি ঝোপের উপর পরে গিয়ে; ব্যথার জায়গায় পিয়াজ লাগানোর পরে কোনো রকমে ব্যাথা সহ্য করে লাঠির ওপর ভোর করে হাঁটতে থাকেন বীরের মত নেতার পিছনে পিছনে। (নিশ্চিতভাবেই, বেশ কয়েকজন বলেছিলেন যে বয়স্ক লোকটি গোড়ালি সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলছিল এবং তিনি কেবল ভান করছিলেন কারণ তিনি ফিরে যেতে ব্যাকুল ছিলেন।) শীঘ্রই, খুব কম লোকই ছিল যাদের হাতে কাঁটা ফুটে যায়নি অথবা মুখে আঁচর লাগেনি। পুরুষরা সমস্ত বীরত্বপূর্ণভাবে সহ্য করেছিল, কিন্তু মহিলারা যাত্রা শুরুর সময়টা কে অভিশাপ দিচ্ছিল এবং শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিল কারণ তারা বুঝতে পারছিল না এই সমস্ত পরিশ্রমের পরিণাম সুখের হবে।
সবাই খুশি এবং আনন্দিত ছিল যে নেতার কিছুই ঘটেনি। সত্য কথা বলতে গেলে, তাঁকে অনেক সুরক্ষায় রাখা হয়ছিল কিন্তু তবুও লোকটি ভাগ্যবান ছিল। প্রথম রাতের শিবিরের জায়গাতে সকলেই ঈশ্বরের প্রার্থনা করেন এবং তাঁকে ধন্যবাদ জানায়, যে সে দিনের যাত্রা সফল হয়ছে এবং নেতার কোনো ক্ষতি হয়নি। তারপরে একজন সাহসী ব্যক্তি কথা বলতে শুরু করে। তার মুখে ব্ল্যাকবেরি ঝোপের আঁচর লেগেছিল। কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল ছিল না।
– ভাইয়েরা, – তিনি বলতে শুরু করেন। – প্রথম দিনের যাত্রা আমরা পিছনে ফেলে এসেছি তাই আমাদের ঈশ্বর কে ধন্যবাদ জানানো উচিত। পথ সহজ নয়, তবুও আমাদের চলতে হবে কারণ আমরা সবাই জানি যে এই কঠিন রাস্তাটি আমাদের সুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আমাদের নেতা কে যে কোনো রকম ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন যাতে তিনি আমাদের সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যেতে পারেন।
– আজকের মতো ঘটনা ঘটলে কাল আমি আমার অন্য চোখটাও হারাব! – একজন মহিলা ক্রোধের সাথে বললেন।
– ওহ, আমার পা! – মহিলার মন্তব্যের দ্বারা উৎসাহিত হয় একজন বয়স্ক লোক বলেন।
শিশুরা কেঁদে চলে, যাতে মুখপাত্রের কথা শোনা যায় তাই বাচ্চাদের চুপ করাতে মায়েদের অনেক কষ্ট করতে হয়।
– হ্যাঁ, আপনি আপনার অন্য চোখটি হারাবেন – তিনি ক্রোধে ফেটে পরে বলেন – এবং আপনি দুটোই হারাতে পারেন! এত বড় উদ্যোগের জন্য একজন জন মহিলার চোখ হারানো কোনও বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় নয়। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত! আপনি কি আপনার সন্তানদের ভালো ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন না? আসুন আমাদের মধ্য থেকে অর্ধেক জন এই উদ্যোগের জন্য প্রাণ ডান করি! তাতে কি পার্থক্য় হবে? একটা চোখের কি মূল্য আছে? আপনার একটা চোখের কি প্রয়োজন যখন একজন আমাদের পথ দেখিয়ে সুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছে? কেবলমাত্র আপনার চোখ এবং একজন বৃদ্ধের একটি পায়ের কারণে কি আমরা এই উদ্যোগ ছেড়ে চলে যাব?
– উনি মিথ্যা কথা বলছেন! বয়স্ক লোকটি মিথ্যা কথা বলছেন! অনি কেবল ভান করছেন যাতে তিনি ফিরে যেতে পারেন, – চারদিক থেকে সবাই বলে ওঠে।
– ভাইয়েরা, যারা আর দুরু যেতে চায় না , – বক্তা আবার বলেন , – তাদের অভিযোগ করে আমাদের উৎপীরিত করার পরিবর্তে ফিরে যাওয়া উচিত। যতদূর আমি জানি, আ,আমার যতক্ষণ জীবন থাকবে আমি এই বিজ্ঞ নেতার কে অনুসরণ করে যাব!
– আমরা সবাই অনুসরণ করব! আমরা যতক্ষণ বেঁচে থাকব আমরা সকলেই তাঁকে অনুসরণ করব!
নেতা নিরব ছিলেন।
সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলতে শুরু করল:
– নেতা চিন্তায় মগ্ন!
– জ্ঞানী মানুষ!
– তাঁর কপালের দিকে তাকান!
– সর্বদা ভ্রুকুটি তাঁর মুখে!
– গম্ভীর!
– তিনি সাহসী! তাঁর সব আচরণ দেখেই তা বোঝা যায়।
– আপনি আবারও তা বলতে পারেন! বেড়া, লগি, ঝোপঝাড় – তিনি সব কিছুই চষে ফেলেন। তিনি কোনো কথা না বলে গম্ভীরভাবে মাটিতে নিজের লাঠি ঠুকতে থাকেন এবং তিনি কি ভাবছেন আপনাকে অনুমান করতে হবে।