ছাপ দেওয়া
আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখি। আমি নিজেও স্বপ্নে এত বিস্মিত হই না, তবে আমি অবাক হয়ে ভেবে যে আমার মধ্যে খারাপ স্বপ্ন দেখার মত সাহস কি করে আসে, যখন আমি নিজে একজন শান্ত এবং শ্রদ্ধেয় নাগরিক, আমাদের ভালোবাসার, দুস্থ মা সার্বিয়ার একজন বাধ্য ছেলে, তার অন্যান সন্তানদের মতোই। অবশ্যই, আপনি জানেন, আমি যদি কোনও ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হতাম তবে এটি অন্যরকম হত, কিন্তু না, আমার প্রিয় বন্ধু, আমি অন্য সবার মতোই একই কাজ করি যেমন সব কাজের প্রতি যত্নবান হওয়া সেই ক্ষেত্রে আমাকে কেউ টেক্কা দিতে পারবে না। একবার আমি রাস্তায় একজন পুলিশ কর্মির ইউনিফর্মের একটি চকচকে বোতাম পড়ে থাকতে দেখি, আমি প্রায় পেরিয়ে চলে যাচ্ছিলাম তখন চকচকে বোতামটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আমার মন মধুর স্মৃতিতে পূর্ণ হয় যায়, যখন হঠাৎ আমার হাত কাঁপতে লাগল এবং আমি সেলাম করালাম; আমার মাথা নিজেই মাটির দিকে নত হল এবং আমার মুখে সেই হাঁসি ফুটে উঠলো যেমন করে আমাদের উর্ধ্বতনদের শুভেচ্ছা জানানোর সময় হাঁসতাম।
– আমার শিরায় আভিজাত্যের রক্ত বইছে – নিশ্চই এটাই কারণ! – সেই মুহুর্তে আমি এটাই চিন্তা করি এবং পাশ দিয়ে যে অভদ্র লোকেরা বোতামের ওপর অযত্নে পা দিয়ে চলে যাচ্ছিল তাদের দিকে বিরক্তির সাথে তাকাই।
– অভদ্র! – আমি বিরক্ত ভাবে বললাম, এবং থুতু ফেললাম, এবং তারপরে চুপচাপ হেঁটে গেলাম, এই ভেবে যে এইরকম অভদ্র মানুষ খুব কমই আছে, এবং আমি বিশেষভাবে খুশী হয়ছিলাম যে ঈশ্বর আমাকে আমার পূর্বপুরুষদের পরিশুদ্ধ হৃদয় এবং মহৎ ও শৌখিন রক্ত দিয়ে আশির্বাদ করেছেন।
আমি এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি দারুন একজন মানুষ, অন্য সম্মানিত নাগরিকদের থেকে মোটেও আলাদা নই, আপনিও তাই অবাক হবেন ভেবে কিভাবে আমার স্বপ্নে এই রকম একটি খরাপ ও বোকামির ঘটনা ঘটতে পারে।
সেদিন আমার সাথে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। আমি ভালো রকম রাত্রি ভোজন করার পরে আমার করে দাঁত খুঁটছিলাম; আমার ওয়াইনে চুমুক দিচ্ছিলাম এবং তারপরে, নাগরিক হিসাবে আমার অধিকার সাহস ও আন্তরিকতার সাথে ব্যবহার করার পরে, আমি একটা বই নিয়ে বিছানায় শুতে যাই আরও দ্রুত ঘুমিয়ে পোড়ার জন্য।
বইটি শীঘ্রই আমার হাত থেকে পড়ে যায় অবশ্যই, আমার আকাঙ্ক্ষাক পূরণ করে, আমার সমস্ত দায়িত্ব পালনের পরে আমি একটি নির্দোষ ভেড়ার মত শান্তিতে ঘুমিয়ে পরি।
হঠাৎ করে আমি নিজেকে পর্বতের মধ্যে একটি সরু কাদাময় রাস্তার উপর দেখি। রাতটি ঠাণ্ডা এবং অন্ধকার ছিল। পাতা শূন্য গাছের ডালের মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা হওয়া বইছিল যা চামড়া কেটে যাচ্ছিল রেজারের মতো। আকাশ ছিল অন্ধকার, নিস্তব্ধ, ভয়াবহ আর তুষার ছিল ধুলার মতো, চোখে ঢুকে যাচ্ছিল, মুখে লাগছিল। আসেপাশে অন্য কোনো প্রাণী দেখা যাচ্ছিল না। আমি তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম এবং মাঝে মাঝেই রাস্তার কাদায় পিছলে পরছিলাম। ঘুরতে ঘুরেতে, পরে যেতে যেতে, অবশেষে আমি রাস্তা হারাই – ভগবান জানেন কোথায়, এটি কোনো ছোট্ট সাধারণ রাত ছিল না, রাতটা এক শতাব্দীর মত দীর্ঘ ছিল, এবং আমি জানিনা কোথায় আমি হেঁটেই চলেছিলাম।
তাই আমি বহু বছর ধরে হেঁটে চলি এবং অনেক অনেক দূরের কোনো এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছাই মার জন্মভূমি থেকে অনেক দূরের কোনো অদ্ভূত জায়গায়, সেই জায়গার কথা হয়তো কেউ জানে না এবং যা আমি নিশ্চিত, কেবল স্বপ্নেই দেখা যায়।
সেই জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে আমি একটি বড় শহরে এসে পরি যেখানে অনেক মানুষের বাস। বড় একটি বাজারে অনেক ভিড় ছিল, ভয়ঙ্কর একটি আওয়াজ হচ্ছিল, কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আমি বাজারে মুখোমুখি একটি সরাইখানায় গিয়ে উঠি এবং মালিক কে জিজ্ঞাসা করি এত লোকে ভিড় কেন করেছে…
– আমরা শান্ত ও শ্রদ্ধেয় মানুষ, – তিনি তাঁর গল্পটি শুরু করেন – আমরা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুগত এবং বাধ্য।
– ম্যাজিস্ট্রেট কি আপনাদের সর্বোচ্চ কর্তা? – আমি তাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করি।
– ম্যাজিস্ট্রেট এখানকার সর্বেসর্বা এবং তিনিই আমাদের সর্বোচ্চ কর্তা; তারপরে পুলিশ।
আমি হাসি।
– হাসছেন কেন?… আপনি কি জানতেন না?… আপনি কোথা থেকে আসছেন?
আমি তাকে বলি আমি কিভাবে পথ হারিয়ে ফেলেছি, এবং আমি বহু দুরের একটি দেশ – সার্বিয়া থেকে এসেছি।
– আমি সেই বিখ্যাত দেশের কথা শুনেছি! – বাড়িওয়ালা নিজেই ফিসফিস করে বলে, আমার দিকে শ্রদ্ধার সাথে তাকিয়ে, তারপরে তিনি উচ্চস্বরে বললেন:
– সেটাই আমাদের ধারা, – তিনি বলতে থাকেন, – ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর পালিশ নিয়ে এখানে আধিপত্য করে।
– আপনাদের পুলিশ কেমন?
– বিভিন্ন ধরণের পুলিশ আছে – এবং তারা তাদের পদমর্যাদা অনুসারে আলাদা হয়। বিশিষ্ট এবং কম বিশিষ্ট পুলিশ আছে… আপনাকে আগেই বলেচি আমরা শান্তিপ্রিয়, শ্রদ্ধেয় মানুষ কিন্তু আসপাসের এলাকা থেকে অভদ্র মানুষেরা এসে পড়ে, তারা আমাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং আমাদের মন্দ নিজিস শেখায়। আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে অন্য ব্যক্তির থেকে আলাদা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট গতকাল একটি আদেশ দিয়েছিলেন যে আমাদের সমস্ত নাগরিককে স্থানীয় আদালতে যেতে হবে, যেখানে আমাদের প্রত্যেকের কপালে লোহা গরম করে ছাপ দেওয়া হবে। এই কারণেই এত লোক একত্রিত হয়েছে: কি করা উচিত সে বিষয়ে পরামর্শ করতে।
আমি হতবাক হয়ে ভেবেছিলাম যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার এই অদ্ভুত দেশ থেকে পালানো উচিত, কারণ আমি একজন সার্ব হওয়া সত্তেও এমন শৌখিন চেতনার সাথে অভ্যস্ত ছিলাম না, এবং এই সম্পর্কে আমার কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল!
বাড়িওয়ালা সদয়ভাবে হেসে ওঠে, এবং আমার কাঁধে হাত রেখে গর্বের সাথে বলেন:
– আহ, অপরিচিত, আপনি কি এতেই ভয় পেয়ে গেলেন? এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমাদের মতো সাহসী হতে গেলে আপনাকে অনেক দূর যেতে হবে!
– আপনি কি বলতে চাইছেন? – আমি ভীত হয় জিজ্ঞাসা করি।
– কি দুর্দান্ত প্রশ্ন! আপনি দেখতে চান আমরা কতটা সাহসী। আমাদের মত সাহসী হতে আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হবে। আপনি অনেকদূর ভ্রমণ করেছেন এবং জগৎ দেখেছেন, তবে আমি নিশ্চিত যে আপনি আমাদের চেয়ে বড় বীর কখনও দেখেননি। আসুন আমরা একসাথে সেখানে যাই। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
আমরা যেতে যাচ্ছি ঠিক তখনি আমরা সামনের দরজায় চাবুকের অওয়াজ শুনলাম।
আমি বাইরে উঁকি দিলাম: একটা দেখার মত দৃশ্য ছিল– একটা লোক মাথায় চকচকে, তিনটি শিংযুক্ত পদস্থ টুপি, জমকালো পোশাক পড়ে অন্য একটা লোকে পিঠে চড়ে চাচ্ছিল যার পরনে ছিল দামি কিন্তু সাধারণ ধাঁচের। তিনি সরাইখানার সামনে দাড়ান এবং আরোহী নেমে আসেন।
বাড়িওয়ালা বাইরে গিয়ে মাথা মাটিতে মাথা নত করেন, এবং জমকালো পোশাক পড়া ব্যক্তিটি সরাইখানার ভিতরে একটি সজ্জিত টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। সাধারণ নাগরিকের পোশাক পড়া লোকটি সরাইখানার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। বাড়িওয়ালা তাকে দেখেও মাথা নত করে প্রণাম করেন।
– এই সব কি হচ্ছে? – আমি হতবাক হয় বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
– যিনি সরাইখানার ভিতরে গেলেন তিনি একজন উচ্চ পদস্থ পুলিশ, এবং এই ব্যক্তিটি আমাদের অন্যতম বিশিষ্ট নাগরিক, খুব ধনী, এবং একজন মহান দেশপ্রেমিক – বাড়িওয়ালা ফিসফিস করে বললেন।
– তবে কেন উনি অন্য একজনকে তাঁর পিঠে চড়তে দিয়েছেন?
বাড়িওয়ালা আমার দিকে মাথা নাড়লেন এবং আমরা একপাশে সরে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে একটি অবজ্ঞাপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন:
– আমরা এটিকে একটি মহান সম্মান হিসাবে বিবেচনা করি যা কদাচিৎ প্রাপ্য! – এ ছাড়াও তিনি আমাকে আরও অনেক কিছু বলেন কিন্তু আমি এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে আমি তার কথা বুঝতে পারিনা। তবে তিনি শেষে যা বলেন তা আমি পরিষ্কারভাবে শুনতে পাই: – এটি দেশের প্রতি এমন একটি সেবা যা সমস্ত জাতি এখনও প্রশংসা করতে শেখেনি!
আমরা বৈঠকে এসে পৌঁছায়ই তখন চেয়ারম্যান নির্বাচন করা শুরু হয় গিয়েছিল।
যদি আমি নামটির সঠিকভাবে মনে পারছি, প্রথম দলটি কল্ব নামক এক ব্যক্তিকে বেছে নেয়, চেয়ারের প্রার্থী হিসাবে তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে; দ্বিতীয় দলটি তাল্ব কে চাইছিল এবং তৃতীয় দলের ও নিজস্ব প্রার্থী ছিল।
ভয়াবহ বিভ্রান্তি ছিল; প্রতিটি দল তাদের নিজস্ব প্রতিনিধির দাবি জানাচ্ছিল।
– আমি মনে করি যে এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সভার সভাপতির পদ গ্রহণ করার জন্য আমাদের কাছে কোল্বের চেয়ে বেশি উপযুক্ত ব্যক্তি আর কেউ নেই, – প্রথম দল থেকে একজন বলে ওঠে – কারণ আমরা সকলেই নাগরিক হিসাবে তাঁর গুণাবলী এবং তার দুর্দান্ত সাহসের কথা জানি। আমি গর্ব করে বলতে পারি যে এখানে আমাদের মধ্যে অন্য আর কেউ উপস্থিত নেই যার পিঠে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এত বড় চড়েছেন…
– এ সম্পর্কে কথা বলার আপনি কে, – দ্বিতীয় দলের কেউ প্রতিবাদ জানায়। – আপনার পিঠে কখনও কোনো নিম্ন পদস্থ পুলিশ ক্লার্ক ও চড়েনি!
– আমরা আপনার গুন সম্পর্কে অবগত, – তৃতীয় দলের কেউ চিৎকার করে বলে ওঠে। – আপনি কখনও চিৎকার না করে চাবুকের এক ঘা ও সহ্য করতে পারেননি!
– একটি কথা ঠিক করে বুঝে নেওয়া ভালো! – কল্ বলতেব শুরু করেন। – এটা ঠিক যে দশ বছর আগের থেকে আমার পিঠে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চড়ছেন; তাঁরা আমাকে চাবুক মেরেছেন এবং আমি এক বারও আয়জায় করিনি, এটা হতেই পারে আমাদের মধ্যে আরো বেশি যোগ্য কোনো ব্যক্তি আছেন। সম্ভবত আরো ভালো এবং বয়স কম।
– না, না, – তাঁর সমর্থকরা কেঁদে ওঠেন।
– আমরা পুরানো পুরষ্কার সম্পর্কে শুনতে চাই না! দশ বছর পেরিয়ে গেছে শেষ যখন কেউ কল্বের পিঠে চড়েছিল, – দ্বিতীয় দল চেঁচিয়ে বলে উঠল।
– কম বয়সীরা দ্বায়িত্ব গ্রহণ করছে বয়স্কদের যেতে দিন – তৃতীয় দলের কিছু লোক বলে উঠল।
হঠাৎ সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল; লোকে পিছনে সরে গেল, ডাইনে বাঁয়ে সরে গেল, রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য এবং আমি প্রায় ত্রিশ বছরের এক যুবককে দেখতে পেলাম। তিনি যখন সামনে এগিয়ে আসছিলেন অন্য সবাই মাথা নত করছিল।
– ইনি কে? – আমি আমার বাড়িওয়ালাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম।
– উনি একজন জনপ্রিয় নেতা। একজন যুবক, কিন্তু খুব আশাব্যঞ্জক। প্রথম দিকে উনি দিনে তিনবার ম্যাজিস্ট্রেটকে তার পিঠে বহন করেছিলেন বলে গর্ব করতেন। তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।
– ওরা সম্ভবত এনাকেই নির্বাচিত করবেন? – আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
– সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি, কারণ অন্য সব প্রার্থীরা – তারা সবাই বয়স্ক, সময়ের কাছে তাদের হার হয়ছে, সেই জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেট গতকাল এঁর পিঠে কিছুক্ষণ চড়েছিলেন।
– এনার নাম কি?
– ক্লেয়ার্ড।
তারা তাঁকে সম্মানের জায়গা দেয়।
– আমি মনে করি, – কল্বের কণ্ঠস্বর নীরবতা ভঙ্গ করে – আমরা এই পদের জন্য ক্লেয়ার্ডের চেয়ে বেশি উপযুক্ত ব্যক্তি আর খুঁজে পাবনা। উনি একজন যুবক কিন্তু তবুও বয়স্কদের মধ্যেও কেউ তাঁর সমান নয়।
– ক্লেয়ার্ডের জয়!… ক্লেয়ার্ড দীর্ঘজীবী হন! – সমস্ত কণ্ঠস্বর গর্জে উঠলো।
কল্ব এবং তাল্ব তাকে চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে গেলেন। সবাই অনেকটা মাথা নত করল, একেবারে নিস্তব্ধতা ছিল।
– ভাইয়েরা, আপনার উচ্চ সম্মান আমাকে সর্বসম্মতভাবে দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ। আপনাদের আস্থা আছে আমার উপর জেনে আমি বাধিত। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতে জাতির ইচ্ছার জাহাজ চালানো করা সহজ নয়, তবে আমি আপনাদের বিশ্বাসকে যথাযত সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করব, সততার সাথে আপনাদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করব এবং এবং যে সম্মান আপনারা আমাকে দিয়েছেন তার যথার্থতা প্রমাণ করতে সব রকম চেষ্টা করব। ভাইয়েরা, আমাকে নির্বাচন করার জন্য ধন্যবাদ।
– হুররে! হুররে! হুররে! – ভোটাররা চারদিক থেকে উল্লাস করে ওঠেন।
– এবং এখন, ভাইয়েরা, আমি আশা করি আপনারা এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি সম্পর্কে আমাকে কিছু কথা বলার অনুমতি দেবেন। আমাদের মধ্যে যে রকম যন্ত্রণা আর কষ্ট জমে আছে তা সহ্য করা সহজ নয়; কারুর পক্ষেই কপালে গরম লোহার ছাপ লাগানো সহজ নয়। আসলে, না – এমন কিছু যন্ত্রণা আছে যা সব পুরুষ সহ্য করতে পারে না। কাপুরুষদের ভয় কাঁপতে দিন, তারা ভয়ে জ্বলে উঠুক, তবে আমরা এক মিনিটের জন্যও যেন না ভুলি যে আমরা সাহসী পূর্বপুরুষের পুত্র, যে মহৎ রক্ত আমাদের শিরাগুলিতে বইছে, আমাদের ঠাকুরদাদের বীরত্বপূর্ণ রক্ত, মহান নাইটরা যারা এক বারও পলক না ফেলে মন্রণ স্বরিকার করত স্বাধীনতা এবং আমাদের সবার মঙ্গলের জন্য, আমরা তাদের তাদের বংশধর। আমাদের যন্ত্রণা সামান্য, আপনি যদি তাদের কষ্টের কথা ভাবেন – আমরা কি এখন আগের চেয়ে অধিকতর উন্নত জীবনযাপন করছি বলে কি আমরা অধঃপতিত ও কাপুরুষোচিত জাতের সদস্যদের মতো আচরণ করব? প্রতিটি সত্য দেশপ্রেমিক, প্রত্যেকে যারা আমাদের জাতিকে সমস্ত বিশ্বের সামনে লজ্জায় ফেলতে চান না, তারা একজন মানুষ এবং বীরের মতো যন্ত্রণা সহ্য করবেন।
– ক্লেয়ার্ডের জয়!… ক্লেয়ার্ড দীর্ঘজীবী হন!
ক্লেয়ার্ডের পরে বেশ কিছু উজ্জীবিত বক্তা কথা বলেছিলেন; তারা আতঙ্কিত লোকদের উৎসাহিত করছিলেন এবং ক্লেয়ার্ড যা বলেছিল কমবেশি তারই পুনরাবৃত্তি করছিলেন।
তারপরে একজন ফ্যাকাশে ক্লান্ত মুখের বৃদ্ধ মানুষ, কথা বলার আজ্ঞা চান, তাঁর মুখে বলি রেখা ছিল এবং চুল ও দাড়ি বরফের মতো সাদা ছিল। তার হাঁটু বয়সের কারণে কাঁপছিল, হাত কাঁপছিল, পিঠ বেঁকে গিয়েছিল।তাঁর কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, চোখ অশ্রুর কারণে উজ্জ্বল ছিল।
– সন্তানেরা, – তিনি শুরু করেন, কুঁচকানো গালের ওপর দিয়ে তার সাদা দাড়ির মধ্য দিয়ে কান্না ঝড়ে পরছিল, – আমার অবস্থা খুব খারাপ এবং আমি শীঘ্রই মারা যাব তবে আমার মনে হচ্ছে আপনারা এই জাতীয় লজ্জা আপনাদের কাছে আসতে দিয়ে চান না। আমার বয়স একশ বছর, এবং আমি ওটা ছাড়া সমস্ত জীবন কাটিয়েছি! … দাসত্বের ছাপ এখন আমার সাদা এবং ক্লান্ত মাথায় কেন লাগানো হবে? …
– ওই বৃদ্ধ দুর্বৃত্ত কে সরিয়ে ফেলো! – চেয়ারম্যান চিৎকার করে ওঠেন।
– ওকে সরিয়ে ফেলো! – অন্যরা চিৎকার করল।
– বুড়ো কাপুরুষ!
– যুবকদের উৎসাহিত করার পরিবর্তে উনি সবাইকে ভয় দেখাচ্ছেন!
– ওনার সাদা চুল সম্পর্কে ওনার লজ্জা হওয়া উচিত! উনি যথেষ্ঠ সময় জীবিত আছেন আর এখনও ভয় পাচ্ছেন – আমরা তরুণরা অনার থেকে বেশি সাহসী…
– কাপুরুষ কে দূরে সরাও!
– ওনাকে বের করে দাও!
– ওনাকে দূরে সরাও!
সাহসী, যুবক দেশপ্রেমীর একটি ক্রুদ্ধ দল বৃদ্ধের দিকে ধেয়ে এলো এবং ক্রোধে তাকে ধাক্কা দিতে লাগল, তাকে ধরে টানাটানি করতে লাগল, এবং লাথি মারতে শুরু করল।
অবশেষে তারা তাঁকে তাঁর বয়সের কারণে ছেড়ে দিল – অন্যথায় তারা তাঁকে জীবন্ত পাথর মেরে মেরে ফেলতে পারত।
তারা প্রত্যেকে প্রতিজ্ঞা করল আগামীকাল সাহসী হওয়ার এবং নিজেদের জাতির গৌরব অর্জনের যোগ্য বলে প্রমাণ করার।
লোকেরা দুর্দান্ত শৃংখলাবদ্ধ ভাবে সভা ছেড়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় তারা বলছিলেন:
– কাল আমরা দেখব কার কত সাহস!
– কাল আমরা মিথ্যা অহংকারীদের চিহ্নিত করতে পারব!
– যোগ্য লোকদের অযোগ্যদের থেকে আলাদা করার সময় এসেছে, যাতে প্রতিটি শঠ সাহসী হওয়ার গর্ব করতে পারবে না!
–
আমি আবার সরাইখানায় চলে গেলাম।
– আপনি কি দেখতে পেয়েছেন আমরা কি দিয়ে তৈরি? – আমার বাড়িওয়ালা আমাকে গর্বের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন।
– প্রকৃতপক্ষে আমি দেখতে পেয়েছি, – আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তর দিলাম, আমার নিজেকে শক্তিহীন মনে হয় এবং আমার মনে অদ্ভূত চিন্তা ভাবনা ঘুরছিল।
সেদিনই আমি তাদের পত্রিকায় একটি শীর্ষস্থানীয় নিবন্ধ পড়েছিলাম যাতে লেখা হয়েছিল:
– নাগরিকগণ, এখন এসেছে অযৌক্তিক অহঙ্কার ও কপটতা বন্ধ করার; আমাদের কল্পিত গুণাবলী প্রদর্শনের জন্য দম্ভ করা বন্ধ করার সময় এসেছে। সময় এসেছে, নাগরিকরা, আমাদের দম্ভ আসল কি নকল তা প্রমাণ করার, এখন প্রমাণ হয় যাবে কে যোগ্য আর কে যোগ্য নয়! তবে আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের মধ্যে এমন কোনও লজ্জাজনক কাপুরুষ নেই যাদেরকে জোর করে নির্ধারিত ছাপ মারার জায়েগায় নিয়ে যেতে হবে। আমরা প্রত্যেকে যারা নিজেদের শিরাতে পূর্বপুরুষদের রক্তের এক ফোঁটা অনুভব করি তারা গর্বের সাথে এবং নিঃশব্দে কষ্ট সহ্য করার জন্য প্রথম সারিতে দাঁড়াবে কারণ এটি আমাদের বলিদান আমাদের দেশ এবং আমাদের সকলের মঙ্গলের জন্য। সামনে এগিয়ে চলুন নাগরিকগণ, আগামীকাল মহৎ পরীক্ষার দিন!…
–
পরের দিন নিযুক্ত স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছানোর জন্য আমার বাড়িওয়ালা সভা শেষ হওয়ার পরেই শুতে চলে গেলেন। অনেকে অবশ্য কাতারের একেবারে সামনে থাকার জন্য সরাসরি টাউন হলে চলে গেলেন।
পরের দিন আমিও টাউন হলে গেলাম। যুবক এবং বৃদ্ধ, পুরুষ এবং মহিলা সবাই সেখানে ছিলেন। কিছু মা তাদের ছোট সন্তানদের কোলে তুলে নিয়ে এসেছিলেন তাদের মাথায়ে ও দাসত্বের ছাপ লাগানোর জন্য, এটি তাদের জন্য সম্মানের বিষয় ছিল যাতে তারা বেসামরিক চাকুরীর উচ্চতর পদে অধিক অধিকার অর্জন করতে পারে।
সেখানে ঠেলাঠেলি গালাগালি চলছিল (এই বিষয় তারা সার্বদের মতোই, যা দেখে আমি একরকম খুশিই হয়ছিলাম) সবাই দরজার সামনে যেতে চাইছিল। কেউ কেউ অন্যের গলাও চাপে ধরছিল।
লোহার শিকগুলি সাদা আনুষ্ঠানিক পোশাক পরিহিত বিশেষ সরকারী কর্মচারী লাগছিলেন তারা মৃদুভাবে লোকেদের বকাবকি করছিলেন:
– ঈশ্বরের দোহাই ঠেলাঠেলি করবেন না, সবার সুযোগ আসবে – আপনারা জন্তু নন, ঠেলাঠেলির প্রয়োজন নেই।
ছাপ দেওয়া শুরু হল। একজন চিৎকার করে উঠলো, অন্য একজন ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো, তবে যতক্ষণ আমি সেখানে ছিলাম ততক্ষণ কেউ শব্দ না করে সহ্য করতে সক্ষম হয়নি।
আমি এই নির্যাতন বেশিক্ষণ দেখতে পারিনি, তাই আমি সরাইখানায় ফিরে যাই, কিন্তু সেখানে ইতিমধ্যেই কিছু লোক উপস্থিত ছিলেন, তারা খাবার খাচ্ছিলেন পান করছিলেন।
– শেষ! – তাদের মধ্যে একজন বলেন।
– আমরা তেমন চিৎকার করিনি, কিন্তু তাল্ব গাধার মত চিৎকার করছিল! … – বলল আরেকজন।
– দেখতে পাচ্ছেন আপনার তাল্ব কেমন, এবং আপনি গতকাল তাকে সভার চেয়ারম্যান বানাতে চাইছিলেন।
– আহ, আপনি কখনোই ঠিক বলতে পারেন না!
তারা ব্যথায় আর্তনাদ করতে করতে কথা বলছিল, কিন্তু একে ওপরের থেকে ব্যাথা লুকানোর চেষ্টা করছিল, কারণ তার চাইছিল না অন্যরা তাকে কাপুরুষ মনে করুক।
ক্লেয়ার্ড নিজের সম্মান হারিয়েছে কারণ সে কঁকিয়েছে, এবং লিয়ার নামক এক ব্যক্তি বীরপুরুষ হয় উঠেছে কারণ সে নিজের মাথায় দুটো চাপ লাগিয়েছে আর ব্যথায় লাগলেও কোনো শব্দ করেনি। সারা শহর শ্রদ্ধার সাথে শুধু তারই চর্চা করছে।
কিছু লোক পালিয়ে যায় কিন্তু সবাই তাদের নিন্দা করছে।
কিছু দিন পরে যার কপালে দুটি চাপ ছিল সে মাথা উঁচু করে গর্বের সাথে ঘুরে বেড়াতে লাগল, এবং সে যেখানেই যেত সবাই মাথ নিচু করে টুপি খুলে বীরকে অভিবাদন জানাত।
পুরুষ, মহিলা এবং বাচ্চারা তার পিছন পিছন ছুটে যেত জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটিকে দেখতে। তিনি যেখানেই যেতেন বিস্ময়ে বিস্মিত হয় মানুষে তার পিছনে পিছনে যেত ফিসফিস করে বলতে বলতে: ‘লিয়ার লিয়ার!… এই সে!… এই সে বির পুরুষ যে চিৎকার করেনি যখন তার কপালে দুটি ছাপ দেওয়া হচ্ছিল!’ সংবাদপত্রের শিরোনামে তাঁকে প্রশংসিত ও মহিমান্বিত করা হয়েছিলেন।
এবং মানুষের ভালবাসা তার প্রাপ্য ছিল।
–
সমস্ত জায়গাতেই আমি এইরকম প্রশংসা শুনে আমার নিজেকে বৃদ্ধ মনে হতে লাগল, আমার শিরাতে অভিজাত্ সার্বীয় রক্ত প্রবাহিত হতে অনুভব করলাম, আমাদের পূর্বপুরুষরা বীর ছিলেন তারা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়ে ছিলেন; আমাদের বীরত্বপূর্ণ অতীত এবং আমাদের কসোভোও রয়েছে। আমি জাতীয় গর্ব এবং অহঙ্কারের কারণে রোমাঞ্চিত বোধ করি এবং আমার জাতটি কতটা সাহসী তা দেখাতে আমি টাউন হলে ছুটে এসে চিৎকার করতে আগ্রহী হয় উঠি:
– আপনি আপনাদের লিয়ারের প্রশংসা কেন করছেন?… আপনারা কখনও আসল বীর দেখেননি! এসে নিজের চোখে দেখুন অভিজাত সার্বিয়ান রক্ত কেমন হয়! আমার মাথায় দুটি নয় দশটি চাপ লাগান!
সাদা পোশাক পরিহিত সরকারী কর্মচারী আমার কপালের কাছে একটি লোহার শিক নিয়ে আসে এবং আমি শুরু করি… আমার স্বপ্ন ভেঙে যায়।
আমি ভয়ে আমার কপাল ঘষি, স্বপ্নে কত অদ্ভূত ঘটনা দেখা যায় ভাবতে ভাবতে।
– আমি তাদের লিয়ারের গৌরব প্রায় ছাপিয়ে গিয়েছিলাম, – আমি ভেবে সন্তুষ্ট হই এবং পাশ ফিরি এবং আমার একটু দুঃখ হয় যে স্বপ্নটা মাঝখানে ভেঙে যায়।
বেলগ্রেডে, 1899।
“রাদ্বয়ে ডোমানোভিচ” প্রকল্পটির জন্য অনুবাদ করেছেন মৈত্রেয়ী মন্ডল, 2020।